কলকাতা: লাল শালুতে মোড়া বিশাল ঝাঁকা। ছন্দে ছন্দে দুলে পুর ভরা থেকে টক জলে চোবানো এবং শেষে শালপাতার বাটিতে দেওয়া। মোড়ে মোড়ে সাধের ও স্বাদের এই ফুচকা বিক্রেতাদের দেখেই আমরা অভ্যস্ত।
কিন্তু এই ‘ফুচকাওয়ালা’ একটু আলাদা। তাঁর নাম জ্যোতির্ময়ী সাহা (Jyotirmoyee Saha)। সোনারপুরে একটি প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ডিপ্লোমা করছেন। অদ্ভুত, না? বি-টেকের ছাত্রী আবার ফুচকাওয়ালা হন কী করে? কেনই বা?
তা হলে আসুন, জ্যোতির্ময়ীর নিজের বয়ানেই শোনা যাক তাঁর কাহিনি। যা তিনি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন।
তরুণীর পোস্টের প্রথম ক’লাইন — ‘হ্যাঁ আমি এক ফুচকাওয়ালা!!! এবং এই ফুচকা বিক্রি করেই নিজের স্বপ্নের দিকে এগিয়ে চলেছি। অনেক কষ্ট করে এই জায়গায় আজ পৌঁছেছি। আজ আমি বলতে পারি, আমি এক গর্বিত ফুচকাওয়ালা। তাই ভাবলাম আপনাদেরকে আমাদের গল্পটা বলি। একটু বড় সময় নিয়ে পড়বেন..’
করোনার দাপটে সব মানুষেরই জীবন কোনও না কোনও ভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। জ্যোতির্ময়ীরাও বাদ পড়েননি। খড়দহ স্টেশন বাজারের কাছে বাবার একটা মুদির দোকান ছিল। কিন্তু প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে সেটা দীর্ঘদিন বন্ধ। মা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। তিনিই কষ্ট করে দুই সন্তানকে পড়াশোনা শিখিয়েছেন। জ্যোতির্ময়ীরা দুই ভাইবোন। বস্তুত তাঁর দাদা দেবজ্যোতিকে নিয়েই ফুচকা-যাত্রার শুরু বলা যায়। কী ভাবে? আবার চোখ রাখি তরুণীর পোস্টে —
‘সময়টা তখন ২০২০ মে মাস। দাদার প্রাইভেট জবের স্যালারিটা হাফ হলো। কারণ করোনা তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে..আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে টান দেখা দিল!! আমি তখন ডিপ্লোমা করছি প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে। স্বপ্ন ছিল একদিন বি-টেক করে বড় কোনও কোম্পানিতে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হব। কিন্তু হঠাৎ করে কেমন যেন কালো মেঘ নেমে এল আমাদের পরিবারে!!’
অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী হিসাবে মা যে রোজগার করতেন, তা সামান্যই। দেবজ্যোতির চাকরির টাকাটা ছিল বড় ভরসা। কিন্তু সেই বেতন অর্ধেক হয়ে গেলে চলে কী করে! উপায় একটা বের করলেন জ্যোতির্ময়ীরা। সঙ্গী স্বপ্ন ও রোখ — ‘সম্বল বলতে বাবার একটি মুদিখানার দোকান, যেটি বিগত ১০ বছর যাবত বন্ধ। দু’তিন মাস কোনও রকম চালানোর পর ভাবতে লেগেছিলাম, হয়তো দোকানটা বিক্রি করে দিতে হবে। কিন্তু আমার ও আমার দাদার স্বপ্ন তাড়া করছিল নতুন কিছু শুরু করার। তখন থেকেই আমাদের ভাবনা দোকানটা নিয়ে কিছু করব। অনেক কিছু ভাবার পর শেষে ঠিক করলাম আমরা ফুচকাওয়ালা হব।’
বীজটা বোনা হয়েছিল এ ভাবেই। কিন্তু নতুন ও ব্যতিক্রমী কিছু করা সব সময়ই কঠিন। মানুষের নানা কটাক্ষ, কটূক্তি যেন পিছু ছাড়তে চায় না। জ্যোতির্ময়ীরাও তা থেকে নিস্তার পাননি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেলে-মেয়ে ফুচকার দোকান দিচ্ছে শুনে অনেকে ঠাট্টা করেছে। কিন্তু ভাইবোন পিছিয়ে যাননি। যাত্রা শুরু করে তাঁদের ফুচকাwala। বাবার দোকান ঘরটাকেই রেনোভেট করে সেখানে হরেক কিসিমের ফুচকা বিক্রি শুরু করেছেন জ্যোতির্ময়ী ও দেবজ্যোতি। সঙ্গে মা-বাবার সহযোগিতা তো আছেই।
ফেসবুকে জ্যোতির্ময়ী লিখেছেন — ‘আজ প্রায় আট মাস হতে চলল আমরা যথেষ্ট জায়গা করে নিয়েছি মানুষের মনে। ফুচকাwala (Fuchkawala) নাম এখন হয়তো অনেকেই জানেন। মানুষের ভালোবাসায় আমরা আজ অনেক পথে এগিয়েছি এবং আমি আমার স্বপ্নের প্রতি আরও একধাপ এগোতে পেরেছি। স্বপ্ন এখনও বড় ইঞ্জিনিয়ার হব। কিন্তু ফুচকাকে ভুলব না। আজ আমরা যেটুকু, তার পিছনে এই ফুচকার অবদান সবচেয়ে বেশি। তাই আরো একটি স্বপ্ন যুক্ত হয়েছে। আমাদের এই ফুচকাwala কে (Fuchkawala) একদিন ব্র্যান্ড করে তুলতে চাই। কিন্তু তার জন্য আপনাদের দরকার।’
আজ, রবিবার টেলিফোনে যোগাযোগ করা হয় জ্যোতির্ময়ীর (Jyotirmoyee Saha) সঙ্গে। জানান, আপাতত বিধিনিষেধ মেনেই চলছে দোকান। সঙ্গে করোনা-বিধি পালন করা হচ্ছে কঠোর ভাবে। মাস্ক, গ্লাভস, নিয়মিত হাত স্যানিটাইজ করা, সবই চলছে। বলেন, ‘আসলে ফুচকা খেতে বরাবরই ভালোবাসি। সেই ভালোবাসা থেকে এই ভাবনা। চিরাচরিত ফুচকার পাশাপাশি নানা ধরনের ফুচকা আমরা রাখছি। বলতে পারেন, বৈচিত্র আমাদের ইউএসপি।’
ছবি সৌজন্যে: ফুচকাwala ফেসবুক পেজ