সেই প্রাচীন কাল থেকে একের পর এক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছে সুন্দরবন। বিপর্যয়ের ধারা আজও অব্যাহত। তবে মোকাবিলার ক্ষেত্রে এখন অনেক অসহায় সুন্দরবনের মানুষ। তার জন্য দায়ী কারা? বিশ্লেষণে অর্জুন পুরস্কার প্রাপ্ত এভারেস্ট জয়ী পর্বোতারোহী তথা পরিবেশপ্রেমী দেবাশিস বিশ্বাস (পঞ্চম পর্ব)
সুন্দরবনের (sundarban) নানা সমস্যার পাশাপাশি ওখানকার ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্সটা আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে। শারীরিক কর্মকাণ্ড কিছু নেই বলে এখন দেখা যাচ্ছে, একটু বয়স্ক লোকেরা বিভিন্ন রোগে পড়ছেন। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সুষম খাবার পাচ্ছে না বলে বেশির ভাগ বাচ্চারা অপুষ্টিতে ভুগছে। ডাক্তার বদ্যির কাছে যাওয়া এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ সুন্দরবনে ডাক্তার বদ্যির সংখ্যা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। আগে গ্রামের লোকেদের হার্টের সমস্যা বলে কিছু শোনা যায়নি, অথচ এখন সেখানে ৪৫-৫০ বছর বয়স থেকেই হার্টের সমস্যা, ডায়াবিটিস, ব্লাড প্রেসার, রক্তাল্পতা খুব কমন। দেখা যাচ্ছে সাধারণত বয়স্ক লোকেরা প্রায় হাজার খানেক টাকা প্রতি মাসে ডাক্তার আর ওষুধের পিছনে খরচ করছেন। নিজেরা বিভিন্ন কাজের মধ্যে জড়িয়ে থাকলে এই খরচ সাশ্রয় হতে পারত। এই দিকগুলোকে ওঁদের মাথায় ঢোকাতে হবে। সব হিসাবে এনে খাতায় কলমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষবাসের লাভটা দেখাতে পারলে তবেই সুন্দরবনের মানুষ অন্যের কাছে জমি দেবেন না, বরং নিজেই কাজটা করতে ব্যস্ত থাকবেন।
অন্যান্য জেলা, যেখানে চাষবাস বেশ ভালো হয়, যেমন বর্ধমান জেলার দিকে যাঁরা পুকুরে মাছ চাষ করেন কিংবা জমিতে ধান বা সব্জি চাষ করেন, তাঁরা কিন্তু অনেকটাই স্বচ্ছল। তাঁরা চাষবাস করেই কিন্তু সুন্দর ভাবে সংসার চালাচ্ছেন, সেই আয়েই তাঁদের সন্তানরা পড়াশোনা করছে। তাঁদের সঙ্গে যদি সুন্দরবন এলাকার একটা চাষির তুলনা করা হয় দেখা যাবে বর্ধমানের একই পরিমাণ জমির মালিক এক চাষি সুন্দরবনের (sundarban) সমপরিমাণ জমির মালিকের থেকে অনেক বেশি স্বচ্ছল। এই তুলনামূলক হিসাব দেখিয়ে যদি বোঝানো হয় যে সুন্দরবনের চাষিরা কতটা পিছিয়ে, বর্ধমান কতটা এগিয়ে, তাহলে তাঁদের বোঝানো যেতে পারে যে এক চাষি বর্ধমানে কৃষিকাজ করে যদি সমস্ত কিছু মেইনটেইন করতে পারেন, তাহলে আপনি কেন পারবেন না? গ্রামের সমস্ত চাষিদের এক জায়গায় এনে এ ভাবে বোঝাতে হবে। কোনও চাষিকে হঠাৎ করে যদি বলা হয় আপনি কোনও ভেড়িকে কিংবা ইটভাটার জন্য জমি দেবেন না, তিনি কেন সেই প্রস্তাবে সায় দেবেন? বরং সেই জমিটা কী ভাবে ব্যবহার করে যে টাকাটা তিনি বসে বসে পাচ্ছেন, তার থেকে বেশি পেতে পারেন সেটা যদি হাতে কলমে দেখিয়ে দেওয়া যায় যে, এ ভাবেই জমিটা নিজের কাছে রেখে ব্যবহার করলে সেই জমি থেকে বেশি আয় করতে পারবেন, তবেই তিনি আগ্রহী হবেন জমিটা নিজের কাছে রেখে নিজের মতো ব্যবহার করায়। আর এটাও তাঁদের বোঝাতে হবে, জমি যদি নিজের হাতে থাকে তাহলে সেই জমিতে কাজ করার স্বাধীনতা পুরোপুরি তাঁদেরই থাকবে। সেই জমি যদি কোনও ইটভাটার মালিক কিংবা ভেড়ির মালিকের সঙ্গে চুক্তিতে চলে যায় কিছুদিন বাদেই সে জমির মালিক হওয়া সত্ত্বেও ওদের হাতের পুতুল হিসাবে পরিণত হবেন।
সুন্দরবনের জমি বর্ধমানের মতো উন্নত নয়, এটা ঘটনা। সে জন্য সুন্দরবনে বর্ধমানের মতো ধানের উৎপাদন হবে এটা আশা করা যায় না। যে ধানের উপযোগী সুন্দরবনের মাটি সেটাই ওখানে চাষ করতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন নোনা জলে ডুবে যাওয়া নোনা মাটিতে ধান চাষের ব্যবস্থা করা। আমাদের সরকার ইতিমধ্যেই নোনা জলে চাষের উপযোগী বীজ ধান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। সেই নোনাজলের ধান বিভিন্ন জমিতে লাগিয়ে তার সফল পরীক্ষা করতে হবে এবং সুন্দরবনের মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সেই আত্মবিশ্বাস নিয়ে আসতে হবে। সুন্দরবনের (sundarban) অধিবাসীরা বেঁচে থাকার তাগিদে যদি সবাই কলকাতার দিকে ছুটে আসেন তাহলে তার পরিণাম হবে মারাত্মক। পাশাপাশি চাই শিক্ষা। ছোট বড় নির্বিশেষে সুন্দরবনের (sundarban) প্রান্তিক মানুষদের প্রথাগত শিক্ষা, জীবিকা সংক্রান্ত ব্যবহারিক শিক্ষা আর তাদের আত্মবিশ্বাস তৈরির কাজে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আজ যেমন ত্রাণ দেওয়ার তাগিদে আপামর সাধারণ ছোট বড় দলে ছুটে যাচ্ছে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে, সে ভাবেই সেই দলগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে এক একটি গ্রামের। এ কাজে প্রয়োজনমতো সাহায্য নিতে হবে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও তার যথার্থ প্রয়োগ করতে হবে সরকার ও প্রশাসনকে। ভিক্ষা নয় তাঁরা যেন মাথা উঁচু করে নিজেদের জোরেই বাঁচতে পারে। তবেই বাঁচানো সম্ভব সুন্দরবনকে। তবেই সুরক্ষিত হবে কলকাতার ভবিষ্যৎ। (শেষ)
Theonlooker24x7.com–র সব খবরের নিয়মিত আপডেট পেতে লাইক করুন ফেসবুক পেজ ও ফলো করুন টুইটার।