সেই প্রাচীন কাল থেকে একের পর এক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছে সুন্দরবন। বিপর্যয়ের ধারা আজও অব্যাহত। তবে মোকাবিলার ক্ষেত্রে এখন অনেক অসহায় সুন্দরবনের মানুষ। তার জন্য দায়ী কারা? বিশ্লেষণে অর্জুন পুরস্কার প্রাপ্ত এভারেস্ট জয়ী পর্বোতারোহী তথা পরিবেশপ্রেমী দেবাশিস বিশ্বাস (চতুর্থ পর্ব)
পরিবেশ বাঁচানো এবং জীবিকার পাশাপাশি সুন্দরবনের মানুষের স্বাস্থ্যের দিকটাও নজর রাখতে হবে। যেমন শহরের লোকেরা বিভিন্ন রকম খাবার খান, তাঁদের ডায়েটে যেমন শাক-সব্জি থাকে, তেমনি মাছ, মাংস বা দুধ, ডিমও থাকে। তাঁরা অনেক বেশি স্বাস্থ্য সচেতন, সুষম খাদ্যের পাশাপাশি অনেকে নিয়মিত ব্যায়াম করছেন। কিন্তু এই সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ, তাঁরা তো ত্রাণের সময় সে ভাবে খাবার বলতে পাচ্ছেন হয়তো শুধু চাল-আলু। কোনও কোনও সময় কিছু ডাল কিংবা চিড়ে। তাঁরা শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার কিন্তু পাচ্ছেন না। আর সারাদিন তাঁর কাটছে অলস সময়। শুধু চাল-ডাল-আলুতে শরীরের যেমন খামতিগুলো মেটে না, ঠিক তেমনি এই অবসর সময়ে তাস খেলে হয়তো সাময়িক আনন্দ পাচ্ছেন কিন্তু তাতে তাঁর প্রকৃত শারীরিক কসরত কিছু হচ্ছে না। এটা তাঁদের বোঝাতে হবে। চাষের পাশাপাশি যে সব্জিগুলো তাঁরা ফলাতে পারবেন তাতে বিভিন্ন রকম সুষম খাবারের যে অভাব, সেটা হয়তো পুষিয়ে নিতে পারবেন। আর চাষবাস নিয়মিত করলে স্বাভাবিক ভাবেই শারীরিক পরিশ্রমও হয়ে যাবে।
দেখা গিয়েছে, বিগত বহু বছর ধরে এই চাষবাস না করার কারণে তাঁদের মধ্যে চাষ করার প্রবণতাটা একদম চলে গিয়েছে। তাঁরা তাদের জমি বেশিরভাগই হয় ভেড়ি মালিক, না হলে ইটভাটার মালিকের কাছে বন্ধক রেখে দিচ্ছেন। তার বিনিময়ে কিছু টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন, আর পায়ের উপর পা তুলে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো অল্প বিস্তর লেখাপড়া শিখে, কেউ ক্লাস সিক্স, কেউ এইট পাস করে কাজের খোঁজে বাইরের রাজ্যে চলে যাচ্ছে। কেউ দিল্লি, কেউ মুম্বই এমনকী তামিলনাড়ু, কেরালাতেও চলে যাচ্ছে বিভিন্ন কাজের টানে। এই অল্প শিক্ষিত যুবকেরা কেউ গ্রামে পড়ে থাকছে না। গ্রামের কোনও ব্যাপারে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ বর্তমানে নেই। যাদের মাধ্যমিক পাস কিংবা আরএকটু বেশি পড়াশোনা তারা তো আরও দূরে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে লেবারের কাজ বা ছোটখাটো কোনও চাকরি জুটিয়ে। খুব বেশি হলে তারা দৈনিক ৫০০ টাকার মতো পাচ্ছে। হিসাব করে দেখছে এ ভাবে মাসে ১৫০০০ টাকা এসে যাচ্ছে। এটা ওদের কাছে অনেক টাকা। ওরা দেখেছে যে সুন্দরবনের থেকে কাজ করে মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় করা অসম্ভব। সুন্দরবনে অত টাকা রোজগার করার কোনও উপায় তাদের নেই। কিন্তু এটা ভাবছে না যে, মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় দেখতে হয়তো ভালো, কিন্তু ওই ১৫ হাজারের মধ্যে ছ’হাজার টাকা কম করে বাড়ি ভাড়ায় চলে যাচ্ছে। এবং বাইরে খুব কষ্ট করে খেয়েদেয়ে থাকলেও মেরেকেটে চার পাঁচ হাজার টাকাই হাতে থাকছে। অথচ সেই সময়টা এবং যদি সেই খাটুনিটা সে নিজের গ্রামে দিত তাহলে যে খরচগুলো অতিরিক্ত করতে হচ্ছে বাইরে থাকার জন্য, সেগুলো করতে হত না। এবং যে টাকাটা হাতে পেত সেটা পুরোপুরি হয়তো সে সঞ্চয় করতে পারত। এই সাধারণ হিসাবটা ওদের বোঝাতে হবে। তার থেকে সুন্দরবনের যুবকরা যদি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষগুলো করতে পারে তা হলে হয়তো বিভুঁই-এ গিয়ে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে মাসে ওই যে চার পাঁচ হাজার টাকা তার এখন সঞ্চয় হচ্ছে, সেটা নিশ্চিত ভাবে আরও বেশি হতে পারত। এই ব্যাপারটা ওদের বোঝাতে হবে। তবে এটা খুব সহজ কাজ না। কিন্তু প্রতিনিয়ত বলতে না থাকলে এখনও যে ক’জন সুন্দরবনে পড়ে আছে তারাও ভবিষ্যতে থাকবে না।
Theonlooker24x7.com–র সব খবরের নিয়মিত আপডেট পেতে লাইক করুন ফেসবুক পেজ ও ফলো করুন টুইটার।